অবন ঠাকুরের কুটুম কাটাম

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি‍র যে যুগপুরুষেরা শিল্প-সংস্কৃতির জগতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গিয়েছেন; অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় এই ভাইপো সমকালীন ভারতীয় শিল্পকলার একজন প্রধান স্থপতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছন। অন্য সতীর্থদের মতো পাশ্চাত্য প্রথায় ছবি আঁকা শিখলেও পরে প্রাচীন ভারতের বিশাল শিল্প ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। অজন্তা, বাগ কিংবা রাজপুত মিনিয়েচারের প্রাচুর্য অবনীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শিল্পের এই বিস্মৃতপ্রায় ধারাগুলির পুনর্জন্ম ঘটতে থাকে তাঁর শিল্পচর্চার মধ্যে দিয়ে। সেই সঙ্গে সূচনা হয় ভারতীয় চিত্রকলার এক নতুন অধ্যায়ের, যার পথিকৃৎ অবশ্যই ছিলেন স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ। যদিও তাত্ত্বিকরা মনে করেন, শুধুমাত্র এই কাজের মাপকাঠি দিয়ে তাঁর মূল্যায়ন করা ভুল হবে। কারণ পেইন্টার হিসেবে তিনি তৈরি করেছিলেন কবিতার মতো ছন্দে ভরা অদ্ভুত লাবণ্যময় এক জগৎ যা শুধুমাত্র নিরঙ্কুশ এক কবির কল্পনাতেই জন্ম নিতে পারে।

চেলো ও বাজনাদার

ঠাকুরবাড়ির সেই বিখ্যাত দক্ষিণের বারান্দায় বসে সারাদিন কাজ করতেন অবনীন্দ্র— হাতের কাছে টেবিলে রাখা ঝুড়িভর্তি কাঠকুটো— এখান সেখান থেকে কুড়িয়ে আনা— এগুলোই হচ্ছে তাঁর পুতুল তৈরির সব উপাদন। আর সাজ-সরঞ্জাম বলতে চার ইঞ্চি করাত, ছোট মাপের বাটালি, পেন্সিল কাটার ছুরি, খেলনার হাতুড়ি ইত্যাদি।

নৌকায় রবীন্দ্রনাথ

প্রকৃত অর্থেই বহুমুখী প্রতিভা ছিল অবনীন্দ্রনাথের, ফলে প্রায়শই রং-তুলি সরিয়ে রেখে অনায়াসে কলম হাতে ঢুকে পড়তেন সাহিত্যের আঙিনায়— বিশেষ করে ছোটদের লেখায় ঘটিয়ে দিতেন এমন স্ফূরণ যা কালোত্তীর্ণ হয়ে রয়ে গিয়েছে। এর পাশাপাশি গানবাজনা আর অভিনয়ের জগতেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতির কথাও অবশ্যই স্মরণযোগ্য। এই মানুষটি জীবনের শেষ পর্বে এসে একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন ছবি আঁকা। ভাইপোর এহেন সিদ্ধান্ত মন থেকে মেনে নিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন—‘নিছক ছবি এঁকে তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তা আর নতুন ভাবে কোনও আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে না, মৌলিক কিছু গড়ে তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার।’ এই মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতেই জীবনের শেষ দশটা বছর তিনি মেতে উঠেছিলেন পুতুল গড়ার এক অভিনব খেলায়।

দীর্ঘদিন অবনীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে থেকে ছবি আঁকা শিখেছিলেন রানী চন্দ। তাঁর লেখায় আছে ঠাকুরবাড়ির সেই বিখ্যাত দক্ষিণের বারান্দায় বসে সারাদিন কাজ করতেন অবনীন্দ্র— হাতের কাছে টেবিলে রাখা ঝুড়িভর্তি কাঠকুটো— এখান সেখান থেকে কুড়িয়ে আনা— এগুলোই হচ্ছে তাঁর পুতুল তৈরির সব উপাদন। আর সাজ-সরঞ্জাম বলতে চার ইঞ্চি করাত, ছোট মাপের বাটালি, পেন্সিল কাটার ছুরি, খেলনার হাতুড়ি ইত্যাদি। ভালো করে দেখেশুনে নিয়ে এক টুকরো কাঠের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন আরেক টুকরো কাঠকে— দরকার মনে করলে হয়তো একটা জায়গা একটু কেটে দিলেন—জোড়া লাগানো হলো সরু তার দিয়ে— কোথাও ঠুকে দিলেন একটা পেরেক। পেঁচিয়ে দিলেন লাল-নীল রাংতা—গুঁজে দিলেন রঙিন পুঁতি— সবই নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করে আনা— তেমন বুঝলে তুলি দিয়ে একটু-আধটু রং বুলিয়ে দেওয়া— আর এইভাবেই তৈরি হয়ে যায় হাঁস, নৌকো, রাজকন্যার মুখ, মণিপুরি নর্তকী কিংবা চেলোবাদক।

অনেক ভেবেচিন্তে অবনীন্দ্রনাথ এদের নাম দিয়েছিলেন কুটুম কাটাম—বলতেন— এদের গড়ন পিটন আমার দেওয়া তো নয়। এরা আসে আমার ঘরে সুখ-দুঃখের ভাগ নিতে কত রূপ ধরে— নতুন নতুন কুটুম জোটে এসে যেমন—এরাও তেমনি। কাঠামো এদের সব অদ্ভুত।

সকাল থেকে বসে বসে হয়তো একটা ছোট্ট কাঠের টুকরোকে চেঁছে-ছুলে, সেই সঙ্গে জ্বলন্ত চুরুটের ছ্যাঁকায় একটা অংশকে পুড়িয়ে কালো করে দিয়ে তৈরি করে ফেললেন হাঁস— তারপর পাশে রাখা বাটির জলে ছেড়ে দিলেন তাকে— কাত হয়ে ভাসতে থাকা সেই হাঁসকে দেখে আনন্দ আর ধরে না অবনীন্দ্রনাথের! কখনও আবার আশ্চর্য হয়ে ভাবতে বসেন কী করে এত তুচ্ছ জিনিসের মধ্যেও কত কী দেখতে পাচ্ছেন— এই বোধ আগে কোথায় ছিল। বাড়ির বাগানে খেলনা গড়ার কাঠ খুঁজতে বেরিয়ে চোখে পড়ে যায় ছাই আর কয়লার আবর্জনার মধ্যে পড়ে থাকা একটুকরো পোড়া কাঠ—অবনীন্দ্রনাথের মনে হয় যেন সদ্য পালক গজানো পায়রার ছানা, ভয়ে সিঁটিয়ে বসে আছে।

টিকিওয়ালা বালাপস গায়ে বামুন

এগুলো তো শুধুমাত্র পুতুল নয়— যেন একেকটা আশ্চর্য সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—‘সত্যিই অবনের সৃজনীশক্তি অদ্ভুত। ওর খেলনাগুলো দিয়ে একটা পাবলিক একজিবিশন করতে বল। খুব ভাল হবে। সবাই দেখুক। অনেক কিছু শিখবার আছে।’ অনেক ভেবেচিন্তে অবনীন্দ্রনাথ এদের নাম দিয়েছিলেন কুটুম কাটাম—বলতেন— এদের গড়ন পিটন আমার দেওয়া তো নয়। এরা আসে আমার ঘরে সুখ-দুঃখের ভাগ নিতে কত রূপ ধরে— নতুন নতুন কুটুম জোটে এসে যেমন—এরাও তেমনি। কাঠামো এদের সব অদ্ভুত। রসের দেবতা ব্রহ্মের কাছ হতে পেয়ে আসে এরা।

সারস অথবা পাখি

বড়ই নিবিড় সম্পর্ক’ ছিল এইসব সৃষ্টির সঙ্গে তাদের স্রষ্টার—এ যেন বাস্তব জগৎকে নতুনভাবে উপলব্ধি করা। আফশোসের বিষয়, অবনীন্দ্রনাথের এই বিশেষ কর্মক্ষেত্রটি রসিকমহলে চিরকালই উপেক্ষিত থেকে গেছে। প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া দূরে থাক আজকের যুগে ক’জনই বা ‘কুটুম কাটাম’-এর কথা মনে রেখেছে। অথচ শিল্পাচার্যের জীবনের শেষ দিনগুলিকে এরাই কিন্তু আনন্দে ভরিয়ে রেখেছিল।

শনিবারের চিঠি, ৫৩ বর্ষ, ৫ম সংখ্যা